পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার বা সোমপুর বিহার

 


পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার

পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার বা সোমপুর বিহার বা সোমপুর মহাবিহার। পাল বংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রী ধর্মপাল দেব(৭৮১-৮২১) অষ্টম শতকের শেষের দিকে বা নবম শতকে এই বিহার তৈরি করেছিলেন। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে আর আলেকজান্ডার কানিংহাম বিশাল স্থাপনা আবিষ্কার করেন।
পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার বা সোমপুর বিহার

ভূমিকা

পাহাড়পুর নওগাঁ জেলা এবং বদলগাছি থানার অধীনস্থ পাহাড়পুর গ্রামে অবস্থিত বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থল। পাকা সড়কের মাধ্যমে গ্রামটির নিকটস্থ রেলস্টেশন জামালগঞ্জ এবং নওগাঁ জয়পুরহাট জেলা শহরের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা রয়েছে। এই প্রত্নস্থল উত্তরবঙ্গের প্লাবনভূমিতে অবস্থিত।

 বিস্তীর্ণ একটানা সমভূমির মাঝে এক সুউচ্চ প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ সম্ভবত একে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। স্থায়ীভাবে পাহাড় নামে পরিচিত এ ধ্বংসাবশ্যের অবস্থান থেকে পাহাড়পুর নামের উৎপত্তি হয়েছে। এটি পার্শ্ববর্তী ভূমি থেকে প্রায় 24 মিটার উঁচু।

পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার বা সোমপুর বিহারের আবিষ্কার

স্বাধীনতা পূর্বযুগের খননের ফলে সম্পূর্ণ মহাবিহার নামে তোর দক্ষিনে ২৭৪.১৫ মিটার ও পূর্ব -পশ্চিমে ২৭৩.৭০ মিটার পরিমাপ বিশিষ্ট বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রকান্ড এই স্থাপনার ১৭৭ টি বসবাস উপযোগী কক্ষ, বিস্তৃত প্রবেশ পথ, অসংখ্য নিবেদন স্তুপ, ছোট ছোট মন্দির, পুকুর ও সংলগ্ন অন্যান্য নিদর্শন ছরিয়ে রয়েছে, মাঝে স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সুউচ্চ একটি মন্দির।

 ক্রুশের দুই বাহুর মধ্যবর্তী স্থানে উদগত অংশ উলঙ্গিতে পোড়ামাটির ফলক এবং প্রস্তর ভাস্কর্য দ্বারা সুশোভিত।আজ থেকে প্রায় 1400 বছর আগে বিআরটি নির্মাণ করা হয়। রাজা দ্বিতীয় ধর্ম পাল এটির নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দীর্ঘ সময় এটি খালি পড়ে থাকে। অর্থাৎ কোন কাজে ব্যবহৃত হয়নি। 

অনেকে মনে করেন, যুগ যুগ ধরে উড়ে আসার ধুলোবালি ও মাটি এর চারিদিকে কমতে থাকার কারণে এক সময় ঢাকা পড়ে এটি পাহাড়ের মত হয়ে যায়। সেই থেকে এর নাম হয়ে যায় পাহাড়পুর। দীর্ঘকাল পরে১৮৭৯ সালে আলেকজান্ডার কানিংহাম এতে আবিষ্কার করেন।

পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার বা সম্পূর্ণ বিহারের নির্মাণ শৈলী ও বিবরণ

সু প্রাচীন এ বিহার এলাকাটি প্রায় চল্লিশ একর জায়গা জুড়ে লালচে মাটির ভূমিতে বিস্তৃত। ২৭ একর জমির উপর এর বিশাল দালান। মাটির নিচের অংশে এটি চার কোন আকারের। বাইরের দেয়ালের গাঁয়ে পোড়ামাটি দিয়ে নানা রকম ফুল ফল, পাখি, পুতু্‌ল, মূর্তি ইত্যাদি বানানো আছে। তারপরে রয়েছে অনেকগুলো অনেকগুলো ছোট বড় হল ঘর।

 দেওয়ালের ভেতরে সুন্দর সার বাধা 177 টি ছোট ছোট ঘর। সামনের দিকে আছে লম্বা বারান্দা। বিহারটিতে আরো আছে পুকুর, স্নান ঘাট , কূপ, রান্নাঘর, খাবার ঘর ও টয়লেট। সবমিলিয়ে বিহারটিতে ৮০০ মানুষের থাকার ব্যবস্থা ছিল।

পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের অন্যান্য দর্শনের স্থান

বিহারের ভিতরে বিশাল উঠানের মাঝখানে বড় এক সুন্দর মন্দির। ধাপে ধাপে উঁচু করে বড় মন্দিরটা বসানো হয়েছে। ওরা মাটির দুই হাজার ফলকের চিত্র দিয়ে মন্দিরের বাইরে আর ভেতরে সাজানো। একই রকম ছোট ছোট মন্দির পুরো বিহারের নানা জায়গায় আছে। বিহারটির পূর্ব- দক্ষিণ কোনে দেয়ালের বাইরে একটা বাধানো ঘাট আছে। ওটাকে বলা হয় সন্ধাবতির ঘাট।

 পাহাড়পুর বিহারের পাশে আছে দেখার মত একটা জাদুকর। সেখানে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা আছে খনন করে পাওয়া অনেক পুরাতন আর দুর্লভ জিনিসপত্র। এই এলাকার একটু দূরে আছে সত্য পীরের ভিটা। সেখানে অনেকেই ভক্তিভরে পার্থনা করে, মানত করে। মূলত পাহাড়পুর নামের যে স্থানটি সবচেয়ে বেশি পরিচিত বাজার নাম শুনলে ঐতিহাসিক স্থানের কথা মনে পড়ে যায় সেই স্থানটি বৌদ্ধদের অতি বিখ্যাত ধর্ম শিক্ষাদান কেন্দ্র হিসেবে এক সময় বেশ সরগরম ছিল।

 এটা ছিল কিছুটা স্কলারশিপ সুযোগ-সুবিধা থাকা টাইপের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এর মত। যেখানে পড়াশোনা করতে চীন, তিব্ব্‌ মায়ানমার, মালয়েশিয়া ইন্দোনেশিয়া থেকেও শিক্ষার্থীরা আসতো। বলে রাখা ভালো এই পাহাড়পুর বৌদ্ধ মন্দিরে যারা পড়াশোনা করতো প্রত্যেকেই কিন্তু বিক্ষোভ বা আজকের দিনের বৌদ্ধ ছিলেন। 

আপনি কি জানেন, পাহাড়পুরের এই বৌদ্ধবিহার বা মন্দিরটি প্রায় ৩০০ বছর ধরে খোলা ছিল এবং এতে শিক্ষাদান কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছিল। আর যেহেতু এই মন্দিরটিকে পাহাড় ঘুরে পাওয়ার গিয়েছিল তাই এর নাম পাহাড়পুর নামকরণ করা হয়েছে। তবে প্রাচীনকালে এর প্রকৃত নাম ছিল সম্পূর্ণ বিহার।

পাহাড়পুর বা সোমপুর বিহার সম্পর্কে ১০ টি বাক্য

জেনে নেওয়া যাক মোট 70.31 একর জমির উপর গড়ে ওঠা এই পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার সম্পর্কিত সর্বমোট দশটি গুরুত্বপূর্ণ এবং তথ্যবহুল বাক্য-


পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার মূলত উত্তর - দক্ষিণে দৈর্ঘ্য ৩৫৭ ফুট প্রস্থের পূর্ব-পশ্চিমে ৩১৪ ফুটের একটি চমৎকার স্থাপনা।


  • এটি একটি শিক্ষা কেন্দ্র হলেও এতে ১৮৮টি বাস উপযোগী কক্ষ, বিস্তৃত প্রবেশপ্‌ এবং অসংখ্য বিনোদন স্তুপ এর ব্যবস্থা রয়েছে।

  • পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার আমাদের বাংলাদেশের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা যা ইতিমধ্যে ইউনেস্কোর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।


  • এই স্থাপনাটি বিশাল আয়তন ও ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে প্রতিবছরই অসংখ্য দর্শনার্থী ছুটে আসেন।


  • স্থাপনাটি কে চাইলে খুব সহজেই ভারতের নালন্দা মহাবিহারের সাথে তুলনা করা যাবে।


  • ধারণা করা হয় আজকের আলোচিত ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটির বয়স প্রায় ৩০০ বছরেরও বেশি।


  • বর্তমানে ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃত এই চমৎকার স্থাপনাটির মালিকানা কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের হাতে।


  • পাহাড়পুরের এই মধ্য মন্দির যখন স্থাপন করা হয়েছিল তখন এটির ভূমি পরিকল্পনা করা হয়েছিল মূলত।


  • সে সময় পাহাড়পুরে এই বিহার এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝিতে খয়ম হিউয়েন সাং বেড়াতে আসেন।


  • মূলত এই বিহার থেকেই সে সময় নালন্দা, বুদ্ধগয়া, প্রভৃতি ভারতীয় বিভিন্ন প্রভিতি স্থানে অর্থ ও ধন রত্ন দান করা হতো।

উপসংহার

পাহাড়পুর বিহারের প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে এটি দাঁড়িয়ে আছে। এখানে এলে বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যা... আমাদের সকলেরই উচিত একবার।এর জন্য হলেও পাহাড়পুর ঘুরে আসা।


এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url