মহাস্থানগড় কোন জেলায় অবস্থিত

 


মহাস্থানগড় কোন জেলায় অবস্থিত

মহাস্থানগড় এর অবস্থান বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলায়. বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার উত্তরে করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরে গেলে এই শহরের ধ্বংসাবশাই দেখা যায় প্রাচীর বেষ্টিত এ নগরীর ভেতরে রয়েছে বিভিন্ন আমলের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।
মহাস্থানগড় কোন জেলায় অবস্থিত

 

কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত এই স্থান মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন শাসক বর্গের প্রাদেশিক রাজধানী ও পরবর্তীকালে হিন্দু সামন্ত রাজাদের রাজধানী ছিল। তৃতীয় খ্রিষ্টাব্দ থেকে পঞ্চদশ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অসংখ্য হিন্দু রাজা ও অন্যান্য ধর্মের রাজারা রাজত্ব করেন।

ভূমিকা

মহাস্থানগড় বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রাচীন পুর আকৃতি। প্রসিদ্ধ এই নগরী ইতিহাসে পুন্ড্রবর্ধন বা পুন্দ্রনগর নামে পরিচিত ছিল। একসময় মহাস্থানগড় বাংলার রাজধানী ছিল। যীশু খ্রীষ্টের জন্মের আগে অর্থাৎ প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে এখানে সভ্য জনপদ গড়ে উঠেছিল। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবেই তার প্রমাণ রয়েছে। ২০১৬ সালে এটিকে সার্কের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

মহাস্থানগড়ের দর্শনীয় স্থানগুলো

প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সমূহে বাংলাদেশ বিশ্বের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু প্রত্নতান্ত্রিক নিদর্শন পাওয়া গেছে যেগুলো সৃষ্টির জন্মের বেশ কিছুদিন আগে বলে ধারণা করা হয়। এই প্রাচীন নিদর্শনগুলো বাংলার মানুষের জীবনযাপন, ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রমাণ রাখে।

 এমনই একটি প্রাচীন প্রত্নতান্ত্রিক স্থান হল বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত মহাস্থানগড়। বাংলাদেশের সর্বপ্রাচীন আর সর্ববৃহৎ নগর পুন্দ্র নগর এর ধ্বংসাবশেষ। বগুড়া শহর থেকে প্রায় 13 কিলোমিটার দূরে বগুড়া ও রংপুর মহাসড়কের পাশে করোতোয়া নদীর পশ্চিম তীরে মহাস্থানগড় অবস্থিত। প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে এখানে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। 

এটি বেশ উচ্চ অঞ্চল(ভূপৃষ্ঠ থেকে ১১৮ ফুট) বিধায় এখানে শহর স্থাপন করা হয়। 1808 সালে ফ্রান্সিস বুকানন প্রথম এটিকে চিহ্নিত করে। ১৮৭৯ সালে ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্ব বিদ আলেকজান্ডার কানিংহাম স্থানটিকে পুন্ডের রাজধানী হিসেবে চিহ্নিত করেন। মহাস্থান ঘরে বহু দর্শনেও ও ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে। স্থানগুলোর নামকরণ ও এর পেছনের কাহিনী সমূহ বেশ চমকপ্রদ ও বিস্ময়কর। নিচে এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্থানগুলোর নাম সহ কাহিনী ও পরিচয় সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো-

  • খোদার পাথর ভিটা
  • পরশুরামের প্রাসাদ
  • মাজার শরীফ
  • মহাকালীর ঢিব
  • শিলা দেবীর ঘাট
  • জিওত কুন্ড
  • বেহুলার বাসর ঘর

খোদার পাথর ভিটা

এটি মহাস্থানগড়ের পূর্বের পাহাড়ে একটি আয়তাকার বুদ্ধমন্দিরের পূর্বাভীমুখী হয়ে অবস্থিত। এটি একটি দীর্ঘ কার চৌকাণাকৃতি মসৃণ পাথর যা সাধারণত প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না। এর উপরে গ্রানাইটের স্তর রয়েছে। ধারণা করা হয়, রাজা পরশুরাম এটিকে সংগ্রহ করে মসৃণ করেছিলে, এবং বলি দেওয়ার কাজে এটি ব্যবহার করতেন। এই ভিটা ১৯৭০ সালে আবিষ্কৃত হয়। এতে মূলত পাল শাসনামলে প্রথমদিকের বেশ কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়।

পরশু রামের প্রাসাদ

এই প্রাসাদ ঘরের সীমানা পাচীরের ভিতর অবস্থিত। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে নির্মিত বিশাল প্রাসাদ এটি। এর ভিতরে চারটি মহল বা অংশ রয়েছে। এছাড়াও বেশ কিছু কক্ষ, সীমানা প্রাচীর, দুটি প্রবেশদ্বার ও দুটি প্রহরিক অক্ষর এখানে দেখতে পাওয়া যায়। প্রাসাদটি রাজা পরশুরামের(১২০৫-১২২০)। পরশু রাম ছিলেন মহাস্থানের শেষ হিন্দু রাজা।

 সেন বংশের শেষ রাজা লক্ষণ সেনের সময়ে মহাস্থানগড়ের রাজা ছিলেন নল। রাজার সঙ্গে তার ভাই নীলের বিরোধ ছিল। এই বিরোধের সুযোগে ভারত থেকে আসা রাম নামের এক ব্রাহ্মণ গড়ের দখল নিয়ে রাজা হন। তিনি পরশু বা কোঠার চালানোতে দক্ষ ছিলেন বিধায় তাকে পরশুরাম নামে ডাকা হতো। শাহ সুলতান বলছি তাকে পরাজিত করে মহাস্থানগড়ে ইসলামিক শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।

মাজার শরীফ

এটি হযরত শাহ সুলতান বলখী মহীসাওয়ার (রহ) এর মাজার শরীফ। মহাস্থান বাস স্ট্যান্ড থেকে পশ্চিম দিকে একটি অবস্থিত। তিনি ছিলেন মূলত 14 শতকের একজন ইসলাম প্রচারক। যিনি এই অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেন। কথিত আছে বোরহান নামক এক ব্যক্তিকে রাজা পরশুরামের কাছ থেকে রক্ষার জন্য তার দোয়ার ভিত্তিতে আল্লাহর ইচ্ছায় শাহ শাহ সুলতান মাথায় রাখতে আকৃতির এক নৌকায় মহাস্থানে আসেন। এজন্য তাকে মহিষাওয়ার বলা হয়ে থাকে। পরবর্তীতে রাজা পরশুরামকে পরাজিত করে শাহ সুলতান এ অঞ্চলে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন।

মহাকালির ঢিবি

মহাকালীর ঢিবি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ হলেও মূলত এটি একটি মন্দির। ১৯৬৫-৬৬ সালে খননের সময় এখানে সুলতানি আমলের মসজিদের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। তবে প্রায় ১৫ মিটারের মতন খননের পরে মসজিদের মাঝে মন্দিরও পাওয়া যায়। কথিত আছে রাজা মানস সিংহ ও তার ভাই তান সিংহ এটি নির্মাণ করেন। এখানে খননের সময় প্রাপ্ত জৈন প্রতিমা দেখে ধারণা করা হয়, কোন এক সময় জৈন ধর্ম গুরুর আবাসস্থল ছিল এটি।

শিলা দেবীর ঘাট

মহাস্থানগড় এর ২০০ মিটার পূর্বে করোতো এক নদীর তীরে অবস্থিত শিলা দেবীর ঘাট। শিলা দেবী ছিলেন মহাস্থানের শেষ হিন্দু রাজা পশুরামের বোন। শাহ সুলতান বলখী মহিষাওয়ার কর্তৃক পরশুরাম পরাজিত হলে এই ঘাটে শিলা দেবী নদীর জলে ডুবে আত্মহত্যা করেন। এজন্য এর নাম হয় শিলা দেবীর ঘাট। যদিও নো পথে পাথর জাতীয় পণ্য খালাস করে ইস্তুপাকারে এখানে রাখা হতো বলে একে শিলা দ্বীপ বলা হতো। 

যা বিবর্তনের মাধ্যমে শিলা দেবীর ঘাট নামে নামকরণ হয়। প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লা দশমীতে হিন্দুরা এ ঘাটে স্নান করে। ১২ বছর পর পর পুরুষ নারায়ণে স্নান উৎসব করে থাকেন। স্নানের সময় বছরের একদিনের জন্য মেলা বসে এখানে।

জিয়ত কুন্ড

এটি মূলত একটি কূপ। ৩.৮৬ মিটার গভীরতা বিশিষ্ট একুফটি রাজা পরশুরাম ১৮শ-১৯শ শতকের মাঝে পানির কষ্ট লাঘবের এর জন্য খনন করেন। কথিত আছে যে, সুলতান বলখী ও রাজা পরশুরাম এর মাঝে যখন যুদ্ধ চলছিল তখন পরশুরামের আহত সৈন্যরা এই কূপের পানি পান করলে সুস্থ হয়ে উঠতো। সেজন্য শাহ সুলতান একটি ছেলের সাহায্যে এক টুকরা গরুর মাংস এই কুপে ফেলেন এবং এর অলৌকিক ক্ষমতা নষ্ট করে দেন। পরবর্তীতে রাজা পরশুরামকে পরাজিত করতে সক্ষম হন।

বেহুলার বাসর ঘর

গড় থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার পশ্চিমে সম্রাট অশোক নির্মিত একটি বৌদ্ধস্তম্ভ রয়েছে। এর উচ্চতা ৪৫ ফুট। স্তম্ভটির পূর্বে ২৪ কোনা বিশিষ্ট একটি গোসলখানা রয়েছে। যা বেহুলার বাসর ঘর নামে পরিচিত। এখানে ৮ ফুট গভীর একটি কূপ রয়েছে। প্রাচীন গ্রন্থ মনসামঙ্গল কাব্যে বেহুলা লক্ষিন্দরের কাহিনী বর্ণিত রয়েছে। কাহিনীতে আমরা জেনেছি, লক্ষিন্দরের বাবা চাঁদ সওদাগর ছিলেন শিবের উপাসক। শিবের কন্যা মনসা।

 কন্যার আবদারের শিব বলেন, যদি তার কোন উপাসক। মনসার পূজা করেন তাহলে মনসা পূজার প্রচলন করবেন। বেহুলা লক্ষিন্দরের বিবাহ হলে বাসর ঘরে সাপের কামড়ে লক্ষিন্দর মারা যান। পরে বেহুলার কষ্ট ও তার ভালবাসা দেখে মনসা লক্ষিন্দর কে বাসে তোলেন এবং চাঁদ সওদাগর তার পূজা করেন। বেহুলা ও লক্ষিন্দরের বাসর হয়েছিল যেখানে সেটি এই বেহুলার বাসর ঘর।

উপসংহার

এছাড়াও এই গড়ে বৈরাগীর ভিটা, মঙ্গলকোট, ভাসু বিহার, কালিদা সাগর, ভীমের জঙ্গ্‌ গোবিন্দ ভিটা, সহ আরো বেশ কিছু প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়। মহাস্থানগড়ে মৌর্য, গুপ্্‌ পাল ও সেন শাসনামলে প্রাদেশিক রাজধানী ছিল। এছাড়া অনেক হিন্দু ও মুসলিম শাসক এখানে তাদের শাসন কার্য চালিয়েছেন। এজন্য প্রত্নতাত্ত্বিক দিক থেকে এটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনা। মহাস্থান কে ২০১৬ সালে সার্কের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url